মানুষ শুধু রাগ পোষে না। অভিমান, অনুরাগ, অনুযোগও পোষে। প্রিয় আকাশ, আজকাল কেমন যাচ্ছে তোমার দিনকাল? জানি প্রতিদিন অজস্র চিঠির ভারে ন্যুব্জ তোমার মেঘ পিওনের ডাকবাক্স। আমার সামান্য চিঠি, তোমার সীমাহীন বিশালতার কিছুই ছুঁতে পারবে না। তাতে অবশ্য কিছুই যায় আসে না। আমি জলচক্রে বিশ্বাসী। তাই বিন্দু বিন্দু জলে তোমাকেই লিখছি। একথা তো সত্যি-জলেরা বাষ্প হয়ে তোমার কাছেই ছুটে যায় আবারও জমাট বাঁধার প্রত্যাশা নিয়ে।
অনেক কথার ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার আগে তোমার প্রতি প্রথম অনুরাগের গল্পটা বলে নিই- বৃহস্পতিবারের কোন এক অলস বিকেল। আকাশজুড়ে মেঘের আনাগোনা এবং হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি। আমি পলকে তাকালাম আমগাছের ফাঁকে একখণ্ড আকাশে, সদ্য বৃষ্টি থামা তোমার গায়ে তখন অপূর্ব সব রঙের রেখা। আরো পরে জেনেছি সেটা রঙধনু। বারবার রঙ বদলের খেলা খেললেও সেই থেকে আমি তোমাকে আর ভুলতে পারিনি।
এখনো মায়ের মুখ মনে পড়লেই আমি তোমাকে দেখি। বিশালতার উপমায় তুমি এসে হাজির হও ঔদার্য নিয়ে, বিষাদের রঙে কাব্য বিনির্মাণেও তোমার সাহায্য চাই। তোমাকে আমি চোখ বন্ধ করে, বন্ধ ঘরে কৃত্রিম ছাদের নিচে বসেও পাই। তুমি সীমার মাঝে অসীমের গুঞ্জরন তুলে, ভুল ভুলে ভাসিয়ে নিয়ে যাও আমাকে মেঘের ডানায়।তোমাকে পাই আমি লেখায়,গানে আর আমার সব না পাওয়ায়। প্রিয় আকাশ- অনুভবের সবটা জুড়েই তুমি আছো …
প্রিয় বারান্দা, কেমন আছো তুমি? অনেকদিন বসা হয়না তোমার বুকে পাতা দোলচেয়ারে। দেখা হয়না চারপাশের ছায়াচিত্র। সকালের প্রথমরোদ, দুপুরের নিস্তব্ধ ক্লান্তি আর বিকেলের নীল আকাশ সবই আজ কেমন যেন দূরের মনে হয়। মনে আছে তোমার? প্রথম দু’টো কাঁটাওয়ালা ক্যাকটাস আনলাম, তোমার বুকের এককোণে রাখবো বলে। একদিন বেখেয়ালে খোঁচা লেগে রক্তারক্তি কাণ্ড, ভিজে একাকার তোমার সাদা বুক। তারপর বারোমাস ছিলো আকাশ জুড়ে রক্ত ঝরার শোক।
দীর্ঘদিন পর মাটির টবে এলো টকটকে গোলাপ, ছিটেফোঁটা রোদ্দুরে কেমন চকচকে হয়ে উঠতো একান্ত সময়গুলো। অনেক সময় বসে বসে মুছে দিয়েছি তোমার বুকের অস্থায়ী ধুলো। চোখের মাঝেও আরো একটা গভীর দৃষ্টি আছে এই কথা ভাবতে ভাবতে কতদিন হারিয়ে গেছি গ্রিল ছুঁয়ে অনন্ত আকাশে। তখনো তুমিই ছিলে এক চিলতে অবসর, অস্থির আমায় ভালোবেসে। আমি আজ স্থির কিন্তু বড্ড ক্লান্ত ! তবুও মাঝে মাঝে উঁচু উঁচু বাড়ির দিকে তাকালেই চোখে পড়ে তোমার মতই কোন বারান্দা, বিশাল পৃথিবীর বুকে সামান্য আশ্রয়, এক জোড়া অতল চোখ। হঠাৎ করেই মন খারাপ হয়, ভুলতে পারিনা প্রিয় বারান্দা, তোমার দূরের আকাশ হবার শোক …
প্রিয় বিষাদ …সুখ সবার কাছেই চরম আরাধ্য।অথচ আমি তোমাকেই ভালোবাসি। পরিপূর্ণ প্রশান্তিতে মগ্ন হয়েও আমি তোমাকে পেলেই খুশি।মুহূর্তে মুহূর্তে বোধের রোদে আমি তোমাকেই খুঁজে পাই।সময়ে অসময়ে বিষাদ পুড়াই। তুমি গালফোলা সকাল,মরে যাওয়া দুপুর আর আক্রান্ত সন্ধ্যায় ঠাঁয় বসে থাকো আমার ভাবনার আঙিনায়।আমি তোমাকেই দেখি কেবল একমাত্র সহায়। তোমাকে দেখি আমি হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গা মাঝরাতে অথবা মন কেমন করা সন্ধ্যেবেলায়।তোমাকে পাই অনুভবে, অসংখ্য না পাওয়ায়।তুমি উড়ে বেড়াও আমার দেয়াল,আমার আঙিনা ছাড়িয়ে কখনো বা আমার পুরো আকাশ জুড়েই …
‘তোমায় আমার লাগে, সূর্য ওঠা, সূর্য ডোবার আগে। একেকটা দিন, মুহূর্তেরও বিন্দু বিন্দু ভাগে।’ সেই ‘তুমি’ টাকে ছাড়া বছরের পর বছর কাটিয়ে দিলেন। শুধু ভুলবোঝা অভিমান ছাড়া ছেড়ে আসার হয়তো কোন যৌক্তিক কারণ ছিল না। সেই এক আকাশ সমান দূরে চলে যাওয়া মানুষটার সাথে সময়ের প্রয়োজনে যদি আবার দেখা হয়, কথা হয়, হয় উষ্ণতা বিনিময়। তারপর আবার এক পৃথিবী দূরে চলে যাওয়া। আপনার মনের উপর দিয়ে যে ঝড়টা বয়ে যাবে তা সামলানোর ক্ষমতা আপনার আছে তো?
মনের দাবির চেয়ে বড় কোন দাবি পৃথিবীতে নেই। মনের বিনিময় তো শুধু মনের সাথেই হয়। অধিকাংশ মানুষই জীবনভর হাতড়িয়ে মরে। পাওয়াটা আর হয়ে ওঠে না। বড় কোন আবেগ,প্রেম কিংবা সহমর্মিতা হৃদয়ে শুধু রক্তই ঝরায়। গন্তব্যহীন, ঠিকানাহীন , দায়বদ্ধতাহীন কোন বিনিময়কে আমি সম্পর্ক বলতে নারাজ। হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব। এটা ছাড়া শুধুই যন্ত্রণা, শুধুই অপমান।
নিজের অনুভূতি, ভালোলাগা, খারাপলাগা কখনো অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে নেই। মানুষের মন তো, সেখানে কোন জোর খাটে না। দাবি তৈরি হওয়ার আগেই দাবি করাটা রীতিমত অন্যায়। না বলতে না পারা আর হ্যাঁ বলার মধ্যে এক পৃথিবী দূরত্ব। কেউ কারো ব্যথা ছুঁতে পারে না। প্রত্যাশার পারদ তাই বাড়তে না দেওয়ায় ভালো। কিন্তু নিয়ম মেনে, হিসেব করে কিছুই যে ঘটে না।কোন প্রকারের মানসিক প্রস্তুতি ছাড়াই যে অনুভূতি জন্ম নেয় তার দায় এবং যন্ত্রণা দুইটাই অসহনীয়।
কাউকে রেসপেক্ট করা মানে তাকে ভালোবাসা না। একটা ফ্যাসিনেশন, ক্ষণিকের দূর্বলতা সেটার রেশ কিন্তু খুব বেশিক্ষণ থাকে না। কোনটা ভালোলাগা, কোনটা ভালোবাসা আর কোনটা বা ক্ষণিকের মোহ সেটাও আমরা অনেকেই গুলিয়ে ফেলি। ভালোবাসা অনেক বড় আর পবিত্র ব্যাপার। যখন তখন যার তার জন্য এটা আসে না।
জেগে আছি … মনের মধ্যে কেমন যেন মোচড় দেয়। কেন এমন হয়? কি করতে পারতাম? কি করলে ভালো হয়? এইসব… তোমার অভিমানী পোস্ট পড়লে কেমন এলোমেলো লাগে…. কনফিউজড হই, এসব কি আমাকে ইনডিকেট করে না? গড়পড়তা… বুঝতে পারি না, বোঝাতেও পারি না। বুঝতে না চাওয়ায় ভালো মনে হয় কখনো…. কি করবো? আসলে তোমাকে অনেক উচুঁতে রাখতে চাই…. কিন্তু বোঝাতে পারি না…. অনিয়ম কোন সমাধান নয়… বুঝি… তারপরও …সবসময় তোমাকে ভালো হাসিখুশি দেখতে চাই। আমার অনেক কিছুর বিনিময়েও, এমনকি আমার বাকি জীবনের খারাপ থাকার বিনিময়ে ও। বিশ্বাস করো।
‘সত্যি বলছি আপনার বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। কেউ কারো ব্যথা ছুঁতে পারে না, কেউ নাহ’-এই কথা কেন আমাকে শুনতে হয়….. আমি মানসিকভাবে মানতে রাজি নই আমি তোমার এতটুকু কম আপন। জানি সবচেয়ে বেশি আপন দাবি করার আমি কেউ না। তারপরও কেন এমন মনে হয়?
আমার হিমালয় সমান অপারগতা আমাকে নীরবে কাঁদাই। যেটা ভাবতে চাই বা ভেবে সুখ পাই, তা হলো তোমার জন্য সবচেয়ে বেশি কেউ ফিল করলে বা সম্পূর্ণভাবে ধারণ করলে সে আমি। দেখো. .. একবার বললে না -সময়ের হাতে ছেড়ে দেন। আমিও একই কথা বলতে চাই। ওয়েট এন্ড সী আমি কেমন রেসপন্স করতে পারি, তোমার যেকোন ডাকে … না-পেয়ে কেঁদেছি যতো, পেয়ে বুঝি তারচে’ অধিক …
কখনো কখনো এমন সময় আসে যখন সব জেনে বুঝেও মুখ বন্ধ করে সহ্য করে যেতে হয়।সমাজ সংসারের ভালোর কথা ভেবে নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছেকে পায়ে দলতে হয়। কারো প্রত্যাশা, শত আবদার, অভিমান, অনুযোগ একপাশে সরিয়ে রেখে নিজের কাজটুকু করে যেতে হয়। পাঁজরভাঙ্গা ব্যথা, একবুক হাহাকার কখনো সংগী হয় হয়তো।কিন্তু শেষপর্যন্ত কিছুই যে আর হাতে থাকে না।আমার অক্ষমতার জন্য স্যরি …
পৃথিবীতে আরেকবার আসার সুযোগ পেলে এমন ভীতু হয়ে নয়, খুব শক্তিমান আর সাহসী হয়ে আসতে চাই। সব অচলায়তন যেন ভাঙতে পারি।মানুষ কি বলবে, ভাববে এই ট্যাবু থেকে যেন বের হতে পারি।
বাণী ইয়াসমিন হাসি
লেখক: সম্পাদক, বিবার্তা২৪ডটনেট